কুতুবদিয়া 'অক্টোবর ট্র্যাজেডি'র আজ ২৯ তম বর্ষপূর্তি।

 

কুতুবদিয়া ট্রাজেডি

কুতুবদিয়া 
'অক্টোবর ট্র্যাজেডি'র 
আজ ২৯ তম বর্ষপূর্তি।


সেদিন ছিলো রবিবার। ১৬ অক্টোবর, ১৯৯৪। আমি সকালে কুতুবদিয়া থেকে মাত্র কক্সবাজারে এসেছি। বিকালের দিকে একটি ফোন পেলাম 'কুতুবদিয়া চ্যানেলে বরযাত্রী বোঝাই একটি ইঞ্জিন বোট ডুবে গেছে।' 


আমার গ্রামের বাড়ি কুতুবদিয়ায় হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। আরো বিস্তারিত জানার জন্যে কুতুবদিয়া টেলিফোন অফিসে যোগাযোগ করলাম। জানলাম, দুপুর একটা'র দিকে কুতুবদিয়া চ্যানেলের উজানটিয়ার মুখে যাত্রীবাহী লঞ্চটি ডুবে যায় । মাতবর বাড়ীর বরযাত্রী নিয়ে এটি মাতারবাড়ী কনে বাড়ীতে যাচ্ছিল। ঘটনার আকস্মিকতায় এবং কোনরকম জীবনরক্ষাকারী সরঞ্জাম না থাকায় খুব কম সময়ের ব্যবধানে নিভে যায় বেশ কিছু জীবন প্রদীপ। খবরটি সাথে সাথেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের শিরোনাম হয়ে আসে। ভয়েস অব আমেরিকা, বিবিসি, বাংলাদেশ টেলিভিশন এ' দুর্ঘটনার খবর বেশ গুরুত্ব সহকারে প্রচার করে। দেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করে শোকবার্তা প্রেরণ করেন এবং যথাসম্ভব সাহায্যের জন্যে জেলা প্রশাসনের প্রতি নির্দেশ দেন। এ' সহানুভুতি ও সহমর্মিতার কথা কুতুবদিয়াবাসী চিরদিন কৃতজ্ঞতা ভরে স্মরণ করবে। 

   সে'দিন সন্ধ্যার পর থেকে শত চেষ্টা করেও সকালের জন্যে অপেক্ষা করা ছাড়া কোন উপায় ছিলো না। পরের দিন খুব ভোরে কুতুবদিয়া যাত্রা করলাম। আমরা যখন পৌঁছেছি, তখন প্রায় ৪০/৪৫ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। পুরো কুতুবদিয়ায় তখন শোকের বন্যা নেমেছে। নিহতদের আত্মীয়- স্বজনের হাহাকারে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। যাদের লাশ পাওয়া যাচ্ছিলো না অনেকে তাদের খোঁজে বেরিয়েছে। কুতুবদিয়া চ্যানেল থেকে ভাসতে ভাসতে লাশ বঙ্গোপসাগরের কিনারা বেয়ে কুতুবদিয়ার পশ্চিম উপকূলে এসে ভাসছিলো। কৈয়ারবিল ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আবদুল মাবুদের লাশ পাওয়া গেছে দু'দিন পর। দীর্ঘ সময় পর অনেকের লাশ সনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছিলো না। অবশেষে প্রায় ৬৫ জনের লাশ পাওয়া গেছে এবং ২/৩ জনের পাওয়া যায় নি। কুতুবদিয়ার ইতিহাসে এটি নজিরবিহীন ঘটনা। 

   এতো চরম মূল্য দেয়ার পরও সরকার, প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের টনক নড়াতে পারে নি, পারে নি আমাদের আত্মবিনাশী ঘুম ভাঙ্গাতে। কুতুবদিয়ার সাথে দেশের মূল ভূ-খণ্ডের যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনো মান্ধাতার আমলের মতোই। কাঠের নৌকায় করে বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে আশি কিলোমিটারের পথ পাড়ি দিতে হয়। সেই নৌকাও পরিচালিত হয় সম্পূর্ণ ব্যক্তিমালিকানায়। চট্টগ্রাম থেকে সপ্তাহে একদিন স্টীমারের ব্যবস্থা আছে, এই স্টীমার এতো আস্তে চলে যে, এতে করে সমুদ্র বিহার করাই উত্তম। মানুষ এর নাম দিয়েছে, ঠেলাগাড়ী। এ'সব অব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করা না গেলে বারবার আমাদেরকে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। 

১৬ ই অক্টোবরের ট্রাজেডি কুতুবদিয়ার মানুষকে আরেকবার ভাববার সুযোগ করে দিয়েছে- যোগাযোগের ক্ষেত্রে আরো সতর্কতা, সচেতনতা ও নিরাপত্তার প্রয়োজন আছে। প্রয়োজন আছে যোগাযোগ ব্যবস্থার অবকাঠামোগত উন্নয়নের। এক্ষেত্রে কুতুবদিয়ার সচেতন জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। 


সূত্রঃ প্রথম প্রকাশিত, দৈনিক পূর্বকোণ, ১৬/১০/১৯৯৯ ইং। 

* 'একজন আইনজীবীর আত্মজীবনী 

জীবন, জীবিকা ও জীবনসংগী'- 'Life, Livelihood & Better-half=LLB' থেকে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চোখের কী হবে জানেন না, মাথার খুলিতে এত গুলি নিয়ে ঘুমাতে কষ্ট হয়।

জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আজহারীকে ছেড়ে দিলো ইমিগ্রেশন পুলিশ

কুতুবদিয়ায় বিদ্যুৎ'স্পৃ'ষ্টে ফারুকের মৃ'ত্যু