রাজশাহী - Rajshahi
(১)
রাজশাহী শহরটাকে আমার কেমন যেন নিরীহ নিরীহ লাগে। পুরো শহরজুড়ে কোথাও কোন ফ্লাইওভার নেই, ঢাকা শহরের মতোন যানজট নেই, ট্রাফিক নেই। একটা থানা শহরের চেহারা যেমন হয় সাধারণত, রাজশাহী শহর ঠিক তেমনই— ফাঁকা ফাঁকা।
রাজশাহী শহরে প্রথম এসেছিলাম ২০১৮ সালে। বিয়ের কথাবার্তা বলার জন্যে। সেবারও মনে হয়েছিলো শহরটা কেমন যেন নিরীহ, গোবেচারা ধরণের। ঘরের একেবারে ভদ্র ছেলেটি যেমন হয়— কাজে-কর্মে নিপুণ, কিন্তু খুব বেশি আহ্লাদি নয়। মাছ-মাংশের চাহিদা নেই, শাক পাতা দিয়েই তার দিব্যি ভরপেট খাওয়া হয়ে যায়। রাজশাহী শহরও তেমনই। কাজের কাজ তারা সব করে, কিন্তু মাথার ওপরে ফ্লাইওভার নেই বলে, বহুতল ভবনে তার আকাশ ছেঁয়ে যায়নি বলে, রাস্তায় যেখানে সেখানে যানজট নেই বলে তার কোন মাথাব্যথা নেই, হাউকাউ নেই। ঘরের নিপাট, ভদ্র ছেলেটি।
এদিক থেকে দেখতে গেলে ঢাকা শহরের সাঁই সাঁই উন্নতি হয়েছে। মাথার ওপরে একগাদা ফ্লাইওভার গজিয়েছে, রাস্তার নিচে গাড়িগুলো শুরু করেছে আমরণ অনশন। মহাখালিতে জ্যামে আটকে উত্তরা পৌঁছাতে গেলে তো জীবন যৌবন সব ফুরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। তারপরও ঢাকা শহরের উন্নতি হয়েছে। আকাশ ছোঁয়া দালান হচ্ছে চারদিকে। রাত হলে নগরী আরো জীবন্ত হয়ে উঠে। ঝিকিমিকি আলোকসজ্জা, ভি আই পি মানুষ আর ভি আই পি গাড়িগুলো প্রমাণ রেখে যায়— ঢাকা এখন মেগাসিটি! হোক না পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর— কিন্তু মেগাসিটি তো!
তবে একান্ত নিরীহ, গোবেচারা টাইপ মানুষ বলেই হয়তো-বা, রাজশাহী শহরটাকেই কেনো যেন ভালো লাগলো। এ যেন আমার আপন আলয়! কাগজে-কলমে আর অবকাঠামোয় আস্ত একটা শহর এটা, অথচ কী প্রাণোচ্ছল আর প্রাণবন্ত! এখানে দালানকোঠার প্রতিযোগিতা নেই, তবে সবুজ অরণ্যের আনাগোনায় ভরপুর। এখানে দম ভরে শ্বাস নেওয়া যায়। দৃষ্টিসীমার মধ্যে সবুজের শ্যামলিমা দেখতে দেখতে এখানে হারিয়ে যাওয়া যায়। এখানে মাথার ওপরে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকা ইমারত নেই, তার বদলে আছে দূরদিগ্বলয়লীন নীল আকাশ।
কিন্তু, দিনশেষে ঢাকার সাথেই ঘর করতে হয় আমাদের। ঢাকা হলো সেই প্রেমিকার মতোই— রূপ নেই বলে যাকে দূরে ঠেলতে গিয়ে, গুণের জন্য তাকেই অধিক আপন করতে হয়। ঢাকা শহরকে অপছন্দ করার একগাদা কারণ দাঁড় করানো যায়, কিন্তু হাজারো লক্ষ মানুষের জীবন এবং জীবিকার কেন্দ্র হয়ে উঠা এই নগরীকে মন থেকে ত্যাগ করেও আসা যায় না। দিল্লিকা লাড্ডু, খাইলেও পস্তাতে হয়, না খাইলেও পস্তাতে হয়।
(২)
রাজশাহী যে নিতান্তই গোবেচারা আর নিরীহ শহর— এই ব্যাপারে আমার মনের সমস্ত সন্দেহ মুহূর্তে দূরীভূত হয়ে গেলো রাজশাহী বিমানবন্দরে নামা মাত্রই। আমাদের থানা শহরের পোস্ট অফিসকেও আমি এরচেয়ে ভালো জমজমাট অবস্থায় দেখতে দেখতে বড় হয়েছি। একটা বিমানবন্দর এলাকা, কিন্তু দূরপাল্লার যানবাহনের কোন বালাই নেই। কিছু অটো, দুটো মাইক্রো ছাড়া বিমানবন্দরের ত্রি-সীমানায় আর কোনো বাহন চোখে পড়লো না যাতে চড়ে আমি আরো দেড়শো কিলোমিটার ভিতরে যেতে পারি। খুবই হতাশ করলো। একবার মনে হলো— ‘আমার ঢাকা শহর-ই ভালো’। অন্তত এমন গরীবি হালত নেই। বিমানবন্দরে নামা মাত্র অন্তত জন পাঁচেক ড্রাইভার দৌঁড়ে আসে কার আগে কে গাড়িতে নিয়ে উঠাবে তার জন্যে।
অনেক চেষ্টার পরে একটা গাড়ি ম্যানেজ করা গেলো, তা-ও মাঝ রাস্তায় নামিয়ে দেবে। সেখান থেকে আরো পঞ্চাশ কিলোমিটার আমাকে অন্য গাড়িতে চড়তে হবে। তাও ভালো যে কিছু একটা অন্তত পাওয়া গেলো। সন্ধ্যাও হয়ে যাচ্ছে, এই একখানা গাড়ি না পাওয়া গেলে এই নীরিহ শহরে আমাকে তো রাত্তির বেলায় শেয়ালের সাথে রাত্রি যাপন করা লাগতো!
আয়িশার আম্মুর সাথে আমার মাঝেমধ্যেই টুকটাক মজার বিতর্ক হয়। বিতর্কের বিষয় কোন জেলা বেশি সেরা? উত্তরবঙ্গ না চট্টগ্রাম?
উনি বাপের বাড়ি থাকাবস্থায় আমি যদি সকালে ফোন দিয়ে জিগ্যেশ করি, ‘কি খেলেন সকালে?’
তিনি বলেন, ‘ভাত খেয়েছি’।
মজা করার জন্যে বলি, - ‘ও, তাই তো! ভাত-ই তো খাবেন! উত্তরবঙ্গের মানুষ আর চিনে কী’!
- ‘আমার বাপ তো আর আপনার মতো বড়লোক না’।
- ‘ব্যাপারটা টাকা-পয়সার না, ব্যাপারটা আভিজাত্যের। চট্টগ্রাম তো শিল্পপতির শহর, আপনি জানেন। সকালবেলা জোশ একটা নাস্তা না হলে আমাদের আসলে চলে না’।
- ‘তাই নাকি? শিল্পপতির শহর বলেই বর্ষার সময়ে শহরের রাস্তাঘাট পানির নিচে তলিয়ে যায়’।
আমি প্রবল আত্মবিশ্বাসের সাথে বলি, ‘আসলে, বর্ষার সময়ে একটা মিনি সমুদ্র সৈকতের বন্দোবস্ত যেহেতু এখানেই হয়ে যায়, তাই এতো কষ্ট করে কক্সবাজার সী-বীচ কিংবা পতেঙ্গা, অথবা সেন্ট মার্টিনে গিয়ে সমুদ্র বিলাস উপভোগ করাটা স্রেফ সময় নষ্ট। জানলার পাশে বসে অথৈ জলের স্রোত দেখতে পারি আমরা। ঢেউয়ের গর্জন শুনে কাটিয়ে দিতে পারি অজস্র রজনী। নাহয় দেখেন, শিল্পপতিদের শহরে জলাবদ্ধতা থাকবে, এটা কোন দেশে, কোন কালে হতে পারে?’
এভাবেই চলতে থাকে আমাদের তর্ক-বিতর্ক। রাজশাহী বিমানবন্দরের এমন গরীবি হালত এবং তাতে যানবাহনের এতো অপ্রতুলতা দেখে নতুন করে আয়িশার আম্মুকে খোঁচানো যাবে। বলবো, ‘এতো বড় শহর, কিন্তু বিমানবন্দরের অবস্থা পোস্ট অফিসের চাইতেও খারাপ। এইসমস্ত ঐতিহ্য নিয়ে আপনারা গর্ব করেন?’
Best writer. 💝
উত্তরমুছুন